কবির সুমন ও ঢাকা

আমরা বড় হয়েছিলাম ভুপেন হাজারিকার গান শুনে শুনে। মনে হত এই লোকটাকে একটা বার যদি দেখতে পেতাম! আমায় একটি শাদা মানুষ দাও যার রক্ত শাদা গানটা শুনলে এখনো পশম দাঁড়িয়ে যায়। ভুপেন হাজারিকা যখন বিজেবিতে গেলো তখন অনেক দুঃখ পেয়েছিলাম। তবুও তার যে সৃষ্টিকে ভালোবেসেছিলাম সেই শিশুবেলা থেকে, সেই সৃষ্টিকে ফেলে দেওয়ার বা বয়কটের কথা মনে হয়নি। তার সৃষ্টির প্রতি, তার যে আবেগ সে আবেগকে কখনো মিথ্যে বলে আমি ভাবতে পারিনা। তার নিজের জন্যেও সে সৃষ্টি মিথ্যা হয়ে যায়না।

ঠিক একই রকম ভাবনা আমার কবির সুমনকে নিয়ে। তার সৃষ্টিকে নিয়ে। ফলে কবির সুমনের পলিটিকেল আইডিওলজির উর্ধ্বে গিয়ে আমি তার অতীত সৃষ্টিকে ভালোবাসি। ভালোবাসব। কবির সুমনের অতীতকে শ্রদ্ধা করব। এদেশে শিল্পীকে শিল্পী হয়ে উঠতে বহু কাঠখড় পোড়াইতে হয়। সঙ্গীতকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া এখানে এখনো রীতিমতো ভয়ানক কষ্টসাধ্য বিষয়। বাবার পয়সা থাকলেও পারবেন না। যদি না সেই পরিবেশ বাপ দিতে পারে। বেঙ্গলে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে তুখোড় এস্রাজ বাদক যিনি ছিলেন, তাকে আমি প্রায়ই মজা করে ওস্তাদ ডাকতাম। বলতাম একদিন তার জীবনী লেখা হবে এস্রাজের গুরুজী হিসেবে। সেখানে আমি কি কি বলব তা নিয়ে করতাম জল্পনা কল্পনা। মাস কিছু আগে শুনলাম ক্যারিয়ার আর জীবন গুছাতে গিয়ে এস্রাজে ক্যারিয়ারের চিন্তা ছাড়তে হলো৷
এরকম উদাহরণ দেওয়া যাবে শত শত। নিজে দেখেছি কোভিডে কত শিল্পী একটা শো হচ্ছেনা বলে ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো ছেড়ে দিলো। শিল্পী হয়ে ওঠার যে সাধনা, যে শ্রম সেটা একদিন দুদিনের বিষয়না। এর পেছনে অর্থ, মেধা শ্রম, সময় অনেক কিছু ব্যয় করতে হয়। সেই শিল্পীর সৃষ্টি শুনতে যাওয়া নিয়ে আমরা যে অর্থের আলাপ করি এটা আমার কাছে অনর্থক লাগে। মেনে নিলাম টাকা পায় ইন্ডাস্ট্রি। টাকা শিল্পীকে আপনি সরাসরি দিচ্ছেন না। শিল্পীকেও টাকা দিচ্ছে ওই ইন্ডাস্ট্রি। ফলে সেও সেই থ্রুতে তার বিজনেস গুছাবে খানিক।

কিন্তু আপনি আমি চাইলেই কি কবির সুমনকে এনে সামনে বসায়ে গান শুনতে পারব? পারব না। মিডিয়ার থ্রুতে উনি আসবেন। মিডিয়া থ্রুতে পয়সা দিতে তাহলে অসুবিধা কোথায় আমি এটা বুঝিনা। শিল্পী গেয়ে পারিশ্রমিক পায়। যেমন ডাক্তার বা ফ্রিল্যন্সাররা কোম্পানির থ্রুতে পারিশ্রমিক পায় বিষয়টা অনেকটা অমন। শিল্পীদের স্ট্রাগলটা এদেশে অন্য পেশার মানুষের চেয়ে অনেক কঠিন। আমি অনেক ইয়াং ব্যান্ডকে দেখি কত পরিশ্রম করে একটা স্টুডিও ভাড়া করে নিজেদের গান করে। এদের গান সময় পেলে আমি পয়সা দিয়ে শুনতে যাই। ফ্রি তে চাইলে ইউটিউবে শুনে নেওয়া যায় এখন। এখানে বার্গেইনিং করাটা আমার নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। আজকাল বহু মানুষ একরুমের ছোটো স্টুডিওতে ৩০০/৫০০ টাকার টিকিট কেটে উঠতি ব্যান্ডের গান শুনতে যায়, কেবল শিল্পীদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার জায়গা থেকে। এই প্র‍্যাক্টিসকে আমার ঠিকঠাক মনে হয়। ঝড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষে পাওয়ার একটা সমাধান এইটাই। কাকতাল বা হাতিরপুল সেশনকেই ধরুন। কত পরিশ্রম করে একটা গান ওরা কম্পোজ করে। সেই গান যখন সামনে বসে ওদের কাছে আবার শোনার আবদার করতে চাই, তখন আমি চাইব সে তার পরিশ্রমের মূল্যটা পাক। আবার দেখুন নতুন হলেও জনমানুষের ডাকে ওরা ফ্রিতে যে গায়না এমন নয় কিন্তু। তাই বলে সবদিন ফ্রি চাইলে তো হলোনা। কবির সুমন আরো বড় শিল্পী। সে জায়গা থেকে তার হয়ত টিকিটের দাম বেশি পড়ে যায়। তাই বলে,সে নিয়ে-সুমনকে নিয়ে-সুমনের গান নিয়ে মানুষের যে অবহেলা অযতন তা বড়ই দুঃখজনক।

এখন সব গানই ইউটিউবে ফ্রিতে শোনা যায়। শিল্পীকে বাড়ি ডেকে গান শুনতে চাইলে তার মূল্যায়ন ইউটিউবের গানের মতন করে করতে চাইলে কি হয়?